আদালতকক্সবাজার

কক্সবাজারে বন আদালতে ব্যতিক্রমী শর্তে আসামীদের জামিন

# সাজার পরিবর্তে ২৩ হাজার ৬৭৫ টি বৃক্ষরোপণ
# নিষ্পত্তি’র ১২৫০ টি মামলায় ১৩১৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ
# বয়োজ্যেষ্ঠদের দেওয়া হয় প্রবেশন

একের পর এক মামলা নিষ্পত্তি করে প্রশংসায় ভাসছেন কক্সবাজারের বন আদালত। সাজার পরিবর্তে প্রবেশন দিয়ে নজির স্থাপন করেছেন বিচারক। গত এক বছর ৯ মাসে ১২৫০ টি মামলা নিষ্পত্তি করেন। তারমধ্যে রায় দেওয়া হয় ৭১১ টি মামলার, খালাস ৪১১ টি এবং ১২৮ টি মামলার সাজা হয়। এসব মামলার মধ্যে ১৩১টি বন মামলায় সাজার পরিবর্তে ২০ হাজার ৮৫০ টি বৃক্ষরোপন ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুুজিবুর রহমানের স্মৃতি বিজড়িত ঝাউবিথীতে ২৭টি মামলায় সাজার পরিবের্ত ২ হাজার ৮২৫ টি বৃক্ষরোপনের কাজ সম্পন্ন করেন। শুধু তাই নয়, সাজার পরিবর্তে ১৫টি মামলায় অভিযুক্তদের প্রবেশনের আদেশ দেন কক্সবাজার চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ৫ নং বন আদালতের বিচারক আসাদ উদ্দিন মোঃ আসিফ। এসব মামলায় প্রায় ১৩১৬ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য নিতে হয়েছে। যা দেশের ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বন আদালত সূত্রে জানা যায়, কক্সবাজারে নির্বিচারে গাছ ও সরকারি পাহাড় নিধন চলে আসছে বহু বছর ধরে। বন বিভাগ, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো অভিযান পরিচালনা করলেও দৃশ্যমান শাস্তি না হওয়ায় পার পেয়ে যান অপরাধীরা। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সিংহভাগ আদালতে মামলার জট থাকলে-ও শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়না। ফলে পরিবেশ পড়েছে চরম হুমকির মুখে। গত কয়েক বছরে কক্সবাজার সদর, রামু, ঈদগাহ, উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় ব্যাপক পরিবেশ নিধন হয়েছে। লক্ষ লক্ষ বনের গাছ কাটার অভিযোগ উঠেছে। সাবাড় করা হয়েছে সরকারি পাহাড়। বন বিভাগ মামলা দিয়েও নিরুপায়। এমন অবস্থায় পরিবেশের বিপর্যয় ঠেকাতে কক্সবাজার চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বিচারক আসাদ উদ্দিন মোঃ আসিফকে ৫নং আদালতে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
কক্সবাজার বন আদালত গঠনের পর বন ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় ২০২২ সালে ২০ ফেব্রুয়ারীতে বিচার কার্যক্রম শুরু করেন বন আদালত। তখন বিভিন্ন আদালতের ৪৬২৩ টি মামলার দায় নিতে হয় আদালতকে। ও-ই বছরে’ই ৬০২ টি মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি হয়। একই বছরের মার্চ মাসে চকরিয়া, কুতুবদিয়া ও মহেশখালী ব্যাতীত সকল বন মামলা আদালতে প্রেরণ করে বিচারক আসাদ উদ্দিন মো আসিফকে দায়িত্ব প্রদান করেন চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আলমগীর মুহাম্মদ ফারুকী।

আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীরা মনে করছেন, এতো দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি সত্যিই প্রশংসনীয়। এছাড়া পুরনো অনেক মামলা নিরসন করার ফলে অন্য আদালতের চাপও অনেকাংশে কমে গেছে। কর্মদক্ষতা ও নিরলস পরিশ্রমের কারণে মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়েছে।
অল্প সময়ের মধ্যে হাজার সংখ্যক মামলা নিষ্পত্তি হওয়ায় বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা বাড়ছে সাধারণ মানুষের, এমনটাই মনে করেছেন তারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, পূর্বে চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিভিন্ন এখতিয়ারসম্পন্ন ম্যাজিস্ট্রেটগণ তাদের নিজ নিজ অধিভুক্ত এলাকায় মামলা আমলে গ্রহণ এবং বিচার সম্পন্ন করতেন। এতে করে বিভিন্ন আদালতের ভিন্ন ভিন্ন সিদ্ধান্ত এবং দ্রুত বিচার নিষ্পত্তিতে সমস্যা হত। জট লেগে যেত মামলার। বর্তমানে পৃথক বন আদালতের সুবাদে আগের জটিলতা নেই। নিজস্ব গতিতে চলছে বিচারের কাজ।
খুরুশকুল কাউয়ার বাজার এলাকার মনিরুল হক। যার মামলা নং ১৪২/২০ সদর। জামিনের শর্তে তিনি ২০০ বিভিন্ন বনজ গাছের চারা লাগিয়েছেন। তিনি বলেন, আমাকে পরিকল্পিতভাবে ফাঁসানো হয়েছে। মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। জজ স্যার আমাকে জেলে না দিয়ে গাছ লাগাতে বলেছেন।
নুর হান। মামলা নম্বর ১৯/২০২২ সদর। জানতে চাইলে তিনি বলেন, চলতি বছরের ২৩ আগস্ট ১০০ টি ঝাউগাছ রোপন করেছি। স্যার চাইলে আমাকে জেলে দিতে পারতেন।
আরেকটি মামলার আসামি শাহ আলম। যার মামলা নম্বর ০৪/২০২২। তিনি শর্ত সাপেক্ষে টেকনাফে ৫০ টি ঝাউগাছ লাগিয়েছেন।
এছাড়া নুরুল আলম গং, যার মামলা নম্বর ১৯/২০২৩ সদর। জামিনের শর্তে গত ২৩ নভেম্বর ৩০০ টি ঝাউগাছ রোপন করেছেন।
বেঞ্চ সহকারী মোহাম্মদ শফিক দৈনিক কক্সবাজারকে বলেন, ‘বন আদালত গঠনের সময় ৪৬২৩ টি মামলার মধ্যে বিচারাধীন ছিল ৪০২১ টি। বিচারক আসাদ স্যার দায়িত্ব গ্রহনের পর ওই বছরেই ৬০২ টি মামলা শেষ করেন। গত এক বছর ৯ মাসের মধ্যে ১২৫০ টি বন মামলা নিষ্পত্তি করেন। এর মধ্যে ১৫৮ টি মামলায় সাজার পরিবর্তে আসামিদের ২৩ হাজার ৬৭৫ টি বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা রোপন করা হয়’। তারমধ্যে ঝাউগাছ, মেহগনি, জাম, গর্জন, চম্পা গামারি ইত্যাদি। তিনি বলেন, ‘ আদালত গঠনের পর প্রচুর মামলার জট ছিল। আসামিরা এদিক ওদিক ছুটাছুটি করতো। এখন সব এক জায়গায় হওয়াতেই সবার জন্য সুবিধা হয়েছে।
জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট মোহাম্মদ তারেক দৈনিক কক্সবাজারকে বলেন, ‘দ্রুত মামলা শেষ করে বন আদালতের বিচারক প্রশংসা কুড়িয়েছেন। সাজার পরিবর্তে বৃক্ষ রোপন ও প্রবেশন দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখছেন। এটি বাদী, বিবাদী, আইনজীবী ও রাষ্ট্রের জন্যও ইতিবাচক’।
অন্য একটি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বনাঞ্চল রক্ষা করার দায়িত্ব সকলের। পরিবেশ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে আর-ও সজাগ থাকতে হবে। বন রক্ষায় সকলে একযোগে কাজ করতে হবে। বন আদালতের বিজ্ঞ বিচারক আসামিদের ক্ষেত্রে সুন্দর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এতে করে উজাড় হয়ে যাওয়া প্রকৃতি নতুন করে প্রাণ সঞ্চার করবে’।
তিনি বলেন, ‘বিজ্ঞ বিচারক আসাদ উদ্দিন মো. আসিফ বন আদালতের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর থেকে কক্সবাজার জেলায় বনের অপরাধ বহুলাংশে কমেছে। জীববৈচিত্র এবং জলবায়ু রক্ষায় এক অনবদ্য ভূমিকা পালন করছে আদালত’।
বিষয়টি নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মো. সরওয়ার আলম। তিনি বলেন, ‘এটি সম্পূর্ণ আদালতের বিষয়। আদালতের বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা। পরিবেশ ধ্বংসের দিয়ে কক্সবাজার এগিয়ে আছে এবং প্রতিদিন কোথাও না কোথাও পাহাড় ও গাছ কাঁটা হচ্ছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি’।
এ বিষয়টি নিয়ে মোবাইলে বক্তব্য দিতে নারাজ উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ‘আদালত নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারছিনা। আপনি অফিসে আসেন সাক্ষাতে কথা বলবো’।
কিছুদিন দৈনিক কক্সবাজারকে দেওয়া এক বক্তব্য বন বিভাগের প্রসিকিউটর এফসিসিও( উত্তর) মো. আলাউদ্দিন বলেছিলেন, একসময়ে বিভিন্ন কোর্টে শুনানি হত। এখন একই সময়ে একই জায়গায় হওয়াতে মামলা শুনানিতে কোনো বেগ পেতে হচ্ছেনা। বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর কর্ম দক্ষতার কারণে অনেক জটিল মামলাও দ্রুত নিষ্পত্তি হচ্ছে। তিনি আসামি এবং সরকার পক্ষ দুজনকেই সমান দৃষ্টিতে দেখেছেন। কোনো পক্ষপাতিত্ব করেননি। এছাড়া বয়স্ক আসামিদের শর্ত মোতাবেক প্রবেশন দিয়ে সুনাম কুড়িয়েছেন। তিনি বলেন, ‘সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতায় এবং এক বছর অবজারভেশনে থাকবে। শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে তাদের কাজ দেওয়া হয়। এক হাজার বৃক্ষ রোপন করা, এতিমদের খাওয়ানো, মাদকবিরোধী কাজ করা, সামাজিক কর্মকান্ডে নিজেকে নিয়োজিত রাখা ইত্যাদি।
কক্সবাজার প্রেস ক্লাবের সভাপতি আবু তাহের বলেন, দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি ও সাজার পরিবর্তে বৃক্ষ রোপন অবশ্যই ইতিবাচক। কারণ, প্রায়ই আদালতে মামলা নিষ্পত্তি হতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। এতে করে বিচারপ্রার্থীরা নানারকমের সমস্যার মধ্যে পড়ে।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, বাংলাদেশে সংরক্ষিত এবং রক্ষিত বনাঞ্চলের মধ্যে কক্সবাজার পর্যটন অন্যতম একটি এলাকা। কিন্তু বনাঞ্চলের ৬০% আজ ধ্বংসের পথে। একদিকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর থাবা অন্যদিকে পাহাড় খেকোদের সরব অবস্থান। বনভূমি ধ্বংসে জড়িত রয়েছে স্থানীয় বাসিন্দা ছাড়াও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে খোদ বনের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা। বনভূমি দখলে সরাসরি তাঁরাই জড়িত। যার ভাগবাটোয়ারার অর্থ হাত বদল হয়ে চলে যায় উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে।
বনবিভাগের দায়িত্বশীল তথ্য বলছে, অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়তে হয় বন বিভাগকে। এখনো ঢাল-তলোয়ার ছাড়া ‘নিধিরাম সর্দার’ বনপ্রহরীরা পাহাড়ি বনগুলোর দেখভাল করেন অনেকটা নিজের জীবন দিয়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *