জাতীয়

টালমাটাল রাখাইন, সমুদ্র পথে ঝুঁকি নিয়ে রোহিঙ্গাদের পাচার বেড়েছে

আন্দামান সাগরে ভাসমান কয়েকশো রোহিঙ্গাকে উদ্ধারে জরুরী আহবান।

আন্দামান সাগরে দুটো বোটে ভাসমান কয়েকশো রোহিঙ্গাকে জরুরী ভিত্তিতে উদ্ধারের জন্য পাশ্ববর্তী দেশগুলোর প্রতি আহবান জানিয়েছে জাতিসংঘ। গত শনিবার ভোরে এধরনের ১৫০ জন রোহিঙ্গা বোঝাই একটি বোট ইন্দোনেশিয়ার আচেহে প্রদেশের উত্তরের সাবাং দ্বীপে পৌঁছেছে বলে জানায় জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা – ইউএনএইচসিআর।
আন্দামান সাগরের আশেপাশে শত শত রোহিঙ্গা নিয়ে দুর্দশাগ্রস্ত বোটগুলো অনুসন্ধান ও উদ্ধারের জন্য গতকাল রোববার জরুরি আবেদন করছে ইউএনএইচসিআর। সংস্থাটি এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, রোহিঙ্গাদের উপচে পড়া বোটের ইঞ্জিন বিকল হয়ে আন্দামান সাগরে লক্ষ্যহীনভাবে ভেসে যাচ্ছে।
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে চরম ঝুঁকির মুখে দুটি নৌকায় চার শতাধিক রোহিঙ্গা রয়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থাটি জানিয়েছে ২০২২ সাল থেকে এপর্যন্ত রোহিঙ্গা শরণার্থীসহ ৫৭০ জনেরও বেশি মানুষ সমুদ্রে অনাকাঙ্খিত মৃত বা নিখোঁজ হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। আরও অনেকে সাগরে দুর্দশায় রয়েছেন সর্তক করে ইউএনএইচসিআর উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রয়োজনীয় খাদ্য ও পানি ফুরিয়ে যাওয়ার আগে তাদের উদ্ধার না করা হলে ব্যাপক প্রাণহানির ঝুঁকি রয়েছে।

জানা গেছে, চলতি মাসে ৬ দিনের মধ্যে সমুদ্র পথে ঝুঁকি নিয়ে ফিশিং বোটে করে এক হাজারের বেশি রোহিঙ্গা ইন্দোনেশিয়ায উপকূলে পৌঁছেছে। নিজ দেশ মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার আলো-আঁধারির মাঝে শত শত রোহিঙ্গা নিরাপদ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশের আশ্রয় ক্যাম্প ছাড়ছে। ইতিমধ্যে উপকূলে ও মালাক্কা প্রণালীতে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে টহল ও নিরাপত্তা জোরদার করেছে ইন্দোনেশিয়া।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমের রিপোর্টে জানা যায়,ইন্দোনেশিয়া কর্মকর্তারা ২০ নভেম্বর /২৩ ইংরেজি বলেছেন,গত ৬ দিনে এক হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা দেশটির পশ্চিম ও উত্তরাঞ্চলীয় আচেহ প্রদেশে নৌকায় করে এসেছে। বেশ কিছুদিন প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র যাত্রায় এসব রোহিঙ্গারা ইন্দোনেশিয়া উপকূলে পৌঁছে। এদের মধ্যে অধিকাংশ নারী ও শিশু রয়েছে।
গত ১৫ নভেম্বর ২৪০ জনেরও বেশি লোক নিয়ে আসা দলকে আচেহের উতারা জেলার উপকূলে কতৃপক্ষ দুইবার ডক করার চেষ্টা প্রতিহত করে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর উদ্বেগের প্রেক্ষিতে গত ১৯ নভেম্বর আচেহ প্রদেশের বিরুয়েন জেলায় ডক করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল বলে জানা গেছে। এসব রোহিঙ্গাদের অধিকাংশই ২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যার কারণে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল।
অন্যদিকে বাংলাদেশের আশ্রয় ক্যাম্পে একাধিক সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপের হানাহানির মুখে চরম নিরাপত্তাহীনতা,খাদ্য অভাবসহ বিভিন্ন অসুবিধা এবং কষ্টের সম্মুখীন কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা। এর মাঝে নিজ দেশে ফেরত যাওয়া কিছুটা আলো-আঁধারি স্বপ্ন দেখছিল রোহিঙ্গারা।
কিন্তু দীর্ঘ প্রায় এক বছর ধরে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও বিদ্রোহী গ্রুপ আরাকান আর্মি বা এএ এর মধ্যে যুদ্ধ বিরতি চলছিল। সে সুযোগে প্রত্যাবাসনের খানিকটা আলো উঁকি মারছিল। কিন্তু যুদ্ধ বিরতি মাঝেও গত এক মাস ধরে রাখাইনে উভয়ের মধ্যে সামরিক উত্তেজনার প্রেক্ষিতে গত ১৩ নভেম্বর হতে আবারো সশস্ত্র রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে উভয়ে।
এতে দেশে ফিরে যাওয়ার যে স্বপ্ন দেখছিল তারও আর সুযোগ নেই বলে জানান উখিয়ার আশ্রয় ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা। তারা জানান, এ অবস্থায় তাদের বেঁচে থাকার আর কোন বিকল্প নেই। তাই তারা এই ধরনের বিপজ্জনক মারাত্মক সমুদ্রযাত্রাকে অবলম্বন করছে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। এসব রোহিঙ্গাদের অধিকাংশ মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাদের অনেকেই ইন্দোনেশিয়া উপকূলে দালালরা ফেলে পালিয়ে যায় বলে জানা গেছে।
যদিও ইন্দোনেশিয়া অতীতে সমুদ্র পথে আসা রোহিঙ্গাদের উদারতা এবং মানবতা দেখিয়েছে। কিন্তু এবার শত শত রোহিঙ্গাকে ডক করার অনুমতি দিতে অস্বীকার করা ইন্দোনেশিয়ার জন্য একটি বড় পদক্ষেপ বলে মনে করে দেশটির নাগরিকেরা। তবে এটাকে মানবিকতার দিক থেকে একধাপ পিছিয়ে গেছে বলেছেন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইন্দোনেশিয়ার নির্বাহী পরিচালক উসমান হামিদ।
ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে তারা ১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশনের সদস্য নয়। ফলে শরণার্থীদের গ্রহণ করার জন্য তাদের কোন দায়িত্ব নেই এবং তা করার ক্ষমতাও নেই। শরণার্থী কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী অনেক দেশও এই শরণার্থীদের জন্য তাদের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। তারা এমন নীতি বাস্তবায়ন করছে যা উদ্বাস্তুদের না আসতে উৎসাহিত করে বলে ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লালু মোহাম্মদ ইকবাল এক বিবৃতিতে বলেছেন।
আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা সেভ দ্যা চিলড্রেন বলেছে, নৌকায় করে ইন্দোনেশিয়ায় আসা এক হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গার মধ্যে ৪৬৫ জন শিশু রয়েছে। যাদের ক্ষুধা, শারীরিক ও মানসিক অবস্থা ভালো না।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা- ইউএনএইচসিআর-এর মতে,ভয় ও ক্ষুধা নিয়ে এ বছর বাংলাদেশ ও মিয়ানমার ছেড়ে ইন্দোনেশিয়া এসেছে ৩,৫৭২ জন। চলতি বছরে সমুদ্র পথে ঝুঁকি নিয়ে আসা উল্লেখিত রোহিঙ্গার মধ্যে প্রায় ৩১ শতাংশ শিশু। এই বছর সমুদ্র যাত্রার সময় ২২৫ জন প্রাণ হারিয়েছে বা নিখোঁজ রয়েছে। যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। ২০২২ সালের একই সময়ে, শুধুমাত্র ১৯৪৭ জন রোহিঙ্গা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়েছিল।
দ্য আরাকান প্রজেক্টের পরিচালক ক্রিস লেওয়া মতে, সমুদ্র পথে ইতিমধ্যে ইন্দোনেশিয়া উপকূলে আসা রোহিঙ্গাদের অধিকাংশ তরুণ- তরুণী, নারী শিশু এবং তাদের বেশিরভাগই বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে এসেছে। রোহিঙ্গারা উদ্বাস্তুরা সাধারণত বর্ষা মৌসুমের শেষের দিকে অক্টোবরে এই ধরনের বিপজ্জনক সমুদ্র যাত্রা শুরু করে। এসব নৌকার বেশির ভাগই প্রায়ই সমুদ্রে ডুবে যায়। তারা প্রায়ই খাদ্য ও পানির অভাবের সম্মুখীন হয় এবং পাচারকারীদের দ্বারা নির্যাতিত হয়।
বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, তারা চাঁদাবাজির মতো বর্বরতার বিপদ থেকে বাঁচতে বাংলাদেশের আশ্রয় ক্যাম্প ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এই বছর রিপোর্ট করেছে যে, বাংলাদেশী কর্তৃপক্ষ একটি অবনতিশীল নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছে এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সশস্ত্র দলগুলোর কর্মকাণ্ডের কারণে ক্রমশ জান মালের ভয় ভীতি বাড়ছে।
এইচআরডব্লিউ-এর এশিয়ার উপ-পরিচালক ফিল রবার্টসন উল্লেখ করেছেন যে,”মূল কথা হল বাংলাদেশ সরকার চায় যত দ্রুত সম্ভব সব রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু মিয়ানমারে ফিরে যাক। যদিও বাংলাদেশের আশ্রয় ক্যাম্পে ১১ টির মত সশস্ত্র গোষ্ঠী চিহ্নিত করেছে। মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলি উল্লেখ করেছে যে ঢাকা সরকারের গৃহীত কার্যক্রম রোহিঙ্গাদের সুরক্ষার জন্য যথেষ্ট নয়। ফলে এ বছরের এ পর্যন্ত ক্যাম্পগুলোতে সহিংসতার ৬০ জনের বেশি মারা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৫ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সময়ে টেকনাফ উপকূল দিয়ে সাগরপথে ট্রলারে করে মালয়েশিয়ায় মানবপাচার হতো জোরেশোরে।পাচারের শিকার লোকজন মালয়েশিয়া পৌঁছালে তাদের মারধর করে পরিবারের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা আদায় করে ছেড়ে দিতপাচারকারীরা।
পরবর্তীতে পাচারের শিকার লোকজন অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় অবস্থান করে সেখানে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়াতেন। ওই সময়ে সাগর পথে মানবপাচারে মৃত্যুঝুঁকি বাড়ায় প্রশাসনের শক্ত অবস্থানের ফলে মানবপাচার অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছিল সেসময়।
২০১৭ সালে ব্যাপক আকারে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা আগমন ঘটলে পরবর্তীতে ২০২০ সালের দিকে সমুদ্র পথে ফের ঝুঁকিপূর্ণ উপায়ে মানবপাচারকারী চক্র সক্রিয় হয়ে উঠে।তবে পুরনো ও নতুন পাচারকারীদের সমন্বয়ে গঠিত মানবপাচার চক্রটি এখন আগের চেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর বলে জানা গেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *