শত বছরের স্বপ্ন পূরন; প্রথম ট্রেনযাত্রায় অন্তহীন আনন্দ
# ঢাকা-কক্সবাজার রেলপথে চালু হল যাত্রীবাহী ট্রেন
# জানুয়ারিতে যুক্ত হবে নতুন কোচ
# বাড়ানো হচ্ছে নজরদারি
কক্সবাজার শহরের গোলদীঘির পাড়ের বাসিন্দা ব্যবসায়ী নাইমুল কাদের শিমুল এক দশক আগে ঢাকার গাজীপুরের বাসিন্দা রোকসানা আকতারকে বিয়ে করেন। দশ বছরের সংসারে স্ত্রীকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি গেছেন হাতেগোনা কয়েকবার। স্ত্রী রোকসানা বেশ ক’বার বাপের বাড়ি যেতে চেয়েও পারেন নি। বাপের যাওয়ার প্রধান বাঁধা ছিল- সড়কপথে গাড়ির চাপ আর দুর্ঘটনার ভয়, এ নিয়ে রোকসানার দুঃখ ছিল। কিন্তু স্ত্রীর মলিন চেহারা দেখে দু’মাস আগে নাইমুল প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ট্রেন চালু হলে সেই ট্রেনে শ্বশুরবাড়ি যাবেন।
অবশেষে শুক্রবার (১ ডিসেম্বর) তাঁর সেই স্বপ্ন পূরণ হলো। প্রথম ট্রেনের যাত্রী হয়ে কক্সবাজার থেকে তাঁরা ঢাকা গেছেন। সেখান থেকে যাবেন গাজীপুর। তাদের সঙ্গে নয় বছর বয়সী কন্যা সামিহা নাইমুলও গেছেন নানার বাড়ি।
এদিন বেলা ১২টা ৩৫মিনিটে ১ হাজার ২০ জন যাত্রী নিয়ে ‘কক্সবাজার এক্সপ্রেস’ ঢাকার উদ্দেশ্যে কক্সবাজার আইকনিক স্টেশন ত্যাগ করে। যাওয়ার আগে নাইমুল-রোকসানা দম্পতিসহ ট্রেনের যাত্রীরা অন্তহীন আনন্দ আর উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে গেলেন, ‘বিজয়ের মাসের প্রথম দিনে সমুদ্র শহর কক্সবাজারে ট্রেন যাত্রা শুরু হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনেক ধন্যবাদ। তিনি আমাদের স্বপ্ন পূরণ করেছেন।’
ট্রেনটির চালক (লোকোমাস্টার) এফএম আবদুল আউয়ালের মতে, প্রথম ট্রেনের চালক হিসেবে ট্রেনটি তাঁর সন্তানের মতো। বললেন ‘আমার প্রথম সন্তান জন্ম হওয়ার পর যে ভালো লাগা ছিল, তেমনি এ ট্রেনের প্রথম চালক হতে পেরে সেই ভাল লাগা কাজ করছে।’
এর আগে কয়েক দফা পরীক্ষামূলক ট্রেন চলাচলের সফল কার্যক্রম শেষে গত ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজার রেল সংযোগ উদ্বোধনের সময় ডিসেম্বর থেকে দুটি ট্রেন চালুর নির্দেশ দেন। শুক্রবার এই ট্রেন চালুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. হুমায়ুন কবীর।
এদিকে প্রথমবার কক্সবাজারের থেকে বাণিজ্যিকভাবে ট্রেন চালুকে কেন্দ্র করে ঝিলংজাস্থ আইকনিক রেল স্টেশনে যাত্রী, কর্মকর্তাসহ উৎসুক মানুষের বেশ উপস্থিতি ছিল। সকাল ১০টার পর থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও রেলওয়ে কর্মকর্তারা যাত্রীদের চেকিং করে চকলেট, রজনীগন্ধা ফুল দিয়ে বরণ করে নেন। পাশাপাশি দেয়া হয় বিভিন্ন নির্দেশনামূলক লিফলেটও।
বাংলাদেশ রেলওয়ের ট্রেন পরিচালক আবদুর রহিম বলেন, ‘ট্রেনটিতে চালকসহ ২৫ জন জনবল রয়েছে। এটি ৯টা ১০মিনিটে ঢাকা পৌঁছেছে। প্রথম বিরতি দেয় চট্টগ্রাম স্টেশনে। তারপর এটি আরও ১৫ মিনিটের বিরতি নিয়েছে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। সেখান থেকে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে শেষ হয় দেশের প্রথম পর্যটন ট্রেনের যাত্রা। ফিরতি ট্রেন কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে ঢাকার কমলাপুর স্টেশন ছেড়েছে রাত সাড়ে ১০টায়।
কক্সবাজার স্টেশন মাস্টার গোলাম রব্বানী বলেন, ‘আন্তঃনগর ‘কক্সবাজার এক্সপ্রেস’ নামের এই ট্রেনটির ২০টি বগিতে ১ হাজার ২০ জন যাত্রী ছিল। ঢাকা-কক্সবাজার রুটে ট্রেন চলাচলে গতিসীমা ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১২০ কিলোমিটার।’
তিনি বলেন, ‘ট্রেনে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এসি চেয়ার আসন ৩৩০টি এবং নন এসি শোভন শ্রেণিতে আসন সংখ্যা ৪৫০। চট্টগ্রামের যাত্রীদের জন্য নির্ধারিত থাকবে দু’টি কোচ। এই রুটে এসি স্নিগ্ধা শ্রেণি ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ১৩২৫ টাকা। নন এসি শোভন শ্রেণির ভাড়া ৬৯৫ টাকা। কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামের ভাড়া এসি ৪৭০ টাকা এবং নন এসি ২৫০ টাকা। ইতিমধ্যে আগামী ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত সকল টিকেট বুকিং হয়ে গেছে।’
রেলওয়ের ট্রেন পরিচালক আবদুর রহিম বলেন, ‘এই রেল লাইনে ট্রেন চালুর বিষয়টি প্রত্যেকের জন্য আনন্দের। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মধ্যদিয়ে এ অঞ্চলের যোগাযোগের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হবে। ঢাকা-চট্টগ্রামমুখী মানুষের অত্যন্ত উপকার আসবে।’
উচ্ছ্বসিত যাত্রীরা :
ঢাকার বাসিন্দা শিক্ষিকা নাজমা আক্তার পরিবারের পাঁচ সদস্যকে নিয়ে গত মঙ্গলবার সড়কপথে কক্সবাজার ভ্রমণে আসেন। তবে ফিরতি যাত্রায় ট্রেন চালুর খবরে অনলাইনে আগাম টিকিট বুকিং দিয়ে রাখেন তিনি।
নাজমা বলেন, ‘প্রথমবার কক্সবাজার থেকে ট্রেনে ঢাকা যাচ্ছি। বাসে অনেক ভোগান্তি ও সময় নষ্ট হতো। ট্রেনে সপরিবারে যেতে পেরে খুবই আনন্দিত। ট্রেন বয়স্কদের জন্য খুবই আরামদায়ক। এখন কক্সবাজারে পর্যটকদের আনাগোনা আরও বাড়বে৷’
যাত্রী মোহাম্মদ আবু সম্রাট বলেন, ‘ঘরে বসে সহজেই টিকেট পেয়েছি। আশা করি ট্রেনের যাত্রা উপভোগ হবে। কোনো অতিরিক্ত দামও নেয়া হয়নি।’
ঢাকার বাসিন্দা মোহনা সরকার বলেন, ‘এই স্টেশনের পরিবেশটা অনেক সুন্দর। প্রথমবার যেতে পারছি অনুভূতিটা অন্য রকম। প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ ট্রেন উপহার দেওয়ার জন্য।’
ট্রেন যাত্রায় পর্যটকদের পাশাপাশি সামিল হয়েছিলেন কক্সবাজারের স্থানীয় বাসিন্দারা। অনেকে হয়েছেন প্রথম ট্রেনযাত্রার সাক্ষী।
কক্সবাজার শহরের নুনিয়ারছড়ার বাসিন্দা মইন উদ্দিন বলেন, ‘বিজয়ের মাসের প্রথম দিনে সমুদ্র শহর কক্সবাজারে ট্রেন এসেছে। এই ট্রেনের যাত্রী হতে পেরে অনেক আনন্দিত। এর মধ্যদিয়ে অর্থনীতির দ্বার উন্মোচিত হবে। পর্যটন সম্ভাবনায় বিশাল ভূমিকা রাখবে।’
গোলদীঘির পাড়ের বাসিন্দা নাইমুল কাদের শিমুল বলেন, ‘কক্সবাজার ট্রেন আসবে আমাদের বাপ-দাদার আমল থেকে তাদের স্বপ্ন ছিল। আজ সেই স্বপ্ন পূরণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁকে অনেক ধন্যবাদ। আজ আমি প্রথম ট্রেন যাত্রী হয়ে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি। অনেক আনন্দিত।’ তাঁর স্ত্রী রোকসানা আক্তার বলেন, ‘ট্রেনে চড়ে বাপের বাড়ি যাচ্ছি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অসংখ্য ধন্যবাদ।’
জানুয়ারিতে যুক্ত হবে নতুন কোচ :
গত ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর হাত দিয়ে কক্সবাজারসহ সারাদেশের মানুষের ট্রেনের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। শুক্রবার থেকে কক্সবাজার-ঢাকা রুটে বাণিজ্যিকভাবে চালু হওয়া ট্রেনটি আপাতত ননস্টপভাবে চলবে। তবে আগামী জানুয়ারিতে এ রুটে নতুন কোচ যুক্ত করা হবে জানিয়েছেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হুমায়ুন কবীর।
হুমায়ুন কবির কবির বলেন, ‘চালু হওয়া এই কোচে জানুয়ারি পর্যন্ত বার্থ বা কেবিন থাকছে না। ইতিমধ্যে নতুন কোচ আসছে। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে কেবিন কোচ সংযুক্ত করা হবে। তখন আরো বেশি যাত্রী পরিবহন করতে পারবো। ’
তিনি বলেন, ‘চলতি মাসের মধ্যে নতুন কোচ দেশে এসে পৌঁছাবে। তখন আমরা চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত একজোড়া ট্রেন সাভিস চালু করব।’
বাংলাদেশ রেল একটি যাত্রীবাহী গণপরিবহন। নিরাপদে স্বাচ্ছন্দে সাশ্রয়ী মূল্যে পর্যটক এবং যাত্রীরা চলাচল করবে এটাই মূল উদ্দেশ্য।’
বাড়ানো হচ্ছে নজরদারি :
বাণিজ্যিক ট্রেন চালুর মধ্যদিয়ে কক্সবাজার আইকনিক রেল স্টেশনে প্রতিদিন বাড়বে ভিড়ও। তাই ট্রেনের এই অগ্রযাত্রার অধ্যায়টি অত্যন্ত আনন্দঘন বলে মনে করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা। এ জন্য বাড়ানো হচ্ছে নজরদারি।
ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার রিজিয়নের অতিরিক্ত ডিআইজি আপেল মাহমুদ বলেন, ‘যাত্রীরা যাতে নিরাপত্তা পায় সে জন্য বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি। চালু করা হয়েছে হেল্পডেক্স ও হটলাইন। পাশাপাশি ষ্টেশন থেকে লাবনী, ডলফিন মোড় পযন্ত টহল টিম কাজ করবে। এককথায়- টুরিস্ট পুলিশ পর্যটক সেবায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
ডিআইজি বলেন, ‘পর্যটকরা মাদক নিয়ে আসবে না। কিন্তু মাদক ব্যবসায়ীরা যদি ট্রেনের শুভ যাত্রাকে কলংকিত করতে চায় তাদের ছাড় দেয়া হবে না। তাদের ধরে ধরে বের করা হবে। এখানে জেলা, রেল, টুরিস্ট পুলিশ থাকবে। সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে মাদক ব্যবসা করার সুযোগ নেই।’