শান্তি-সম্প্রীতি ইসলামের চিরন্তন আদর্শ
ইসলাম শান্তি-সম্প্রীতি ও মানবতার শাশ্বত, পূর্ণাঙ্গ এক জীবনব্যবস্থা। কোনরূপ সহিংসতা, বিবাদ-বিসংবাদের স্থান ইসলামে নেই। ন্যূনতম শান্তি-শৃঙ্খলা ও সম্প্রীতি বিনষ্ট হয় এমন আচরণকেও ইসলাম প্রশ্রয় দেয় না। পবিত্র কোরআন মজীদে আল্লাহপাক ইরশাদ করেন ‘ফিৎনা-ফাসাদ বা দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করা হত্যার চেয়েও কঠিন অপরাধ।’ -(সুরা বাকারা, আয়াত-১৯১)। ‘পৃথিবীতে শান্তি স্থাপনের পর তাতে ফাসাদ সৃষ্টি করো না।’ -(সূরা আ’রাফ, আয়াত-৫৬)।
অমুসলিমদের প্রতিও কোন অন্যায় আচরণ ইসলাম অনুমোদন করে না। শান্তি-সৌহার্দ্য ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সুরক্ষায় ইসলামের রয়েছে শ্বাশত আদর্শ ও সুমহান ঐতিহ্য। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সাথে আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ স. এর প্রতিটি আচরণ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিরল ও প্রোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ স. মক্কা থেকে মদীনা হিজরত করার পর যে ‘মদীনা সনদ’ প্রণয়ন করেন তা বিশ্ব ইতিহাসের সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান এবং শান্তি-সম্প্রীতির ঐতিহাসিক দলিল। এই সনদে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষাসহ সংখ্যালঘুদের অধিকার ও নিরাপত্তা প্রদান সম্পর্কিত উল্লেখযোগ্য ধারা সন্নিবেশিত রয়েছে। যেমন “সনদে স্বাক্ষরকারী সকল গোত্র-সম্প্রদায় ‘মদীনা রাষ্ট্রে’ সমান অধিকার ভোগ করবে, সকল ধর্মসম্প্রদায়ের স্ব-স্ব ধর্ম-কর্ম পালনের স্বাধীনতা ও অধিকার যথারীতি বহাল থাকবে; কেউ কারও ওপর কোনরূপ আক্রমণ করবে না, সন্ধিভুক্ত কোন সম্প্রদায় বহিঃশত্রুকর্তৃক আক্রান্ত হলে উক্ত আক্রান্ত সম্প্রদায়কে সম্মিলিতভাবে সহযোগিতা করতে হবে এবং শত্রুদের প্রতিহত করতে হবে, কোন নাগরিক কোন অপরাধ করলে তা তার ব্যক্তিগত অপরাধ বলে গণ্য করা হবে।” (সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ ২য় খ-, পৃষ্ঠা ৯৪। ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রকাশিত)।
এভাবে ঐতিহাসিক মদীনা সনদের মাধ্যমে শান্তির বার্তাবাহক বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ স. ধর্ম-বর্ণ, জাতি-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সকলের মাঝে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি, সাম্য-মৈত্রীর সুদৃঢ় বন্ধন রচনা করে আদর্শ কল্যাণ রাষ্ট্রের অদ্বিতীয় নজির স্থাপন করেন। মুসলিম ও কুরাইশদের মাঝে স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক হুদায়বিয়ার সন্ধির বেশক’টি ধারা ছিল মুসলিম স্বার্থবিরোধী। এতদসত্ত্বেও সুদূরপ্রসারী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মহানবী হযরত মুহাম্মদ স. তা মেনে নেন। কিন্তু প্রতিপক্ষের প্রতিনিধি সুহাইল ইবনে আমর হুদায়বিয়ার সন্ধিতে হযরত মুহাম্মদ স. এর নামের সাথে ‘রাসূলুল্লাহ’ লেখা যাবে না মর্মে আপত্তি জানিয়ে বলল, আমি যদি সাক্ষ্য দিতাম যে, আপনি আল্লাহর রাসূল, তাহলে তো আর আপনার সাথে যুদ্ধ-বিগ্রহ হতো না, আপনাকে বায়তুল্লাহ যেতে বাধা দিতাম না। তখন রাসূল স. সন্ধির লেখক হযরত আলী র. কে বললেন ‘রাসূলুল্লাহ’ শব্দটি কেটে দিয়ে ওর ইচ্ছানুযায়ী শুধু আমার নাম লিখ। এতে হযরত আলী র. অপারগতা প্রকাশ করায়, রাসূলে কারীম স. নিজ হাতেই তা কেটে দিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও উদারতার অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত পেশ করেন। (সীরাতুন্নবী স. ইবনে হিশাম, ৩য় খ-, পৃষ্ঠা-৩৩১ ও সীরাতুল মোস্তফা স. আল্লামা ইদ্রিস কান্দলবী রহ. ২য় খ- পৃষ্ঠা-৩০৯)।
ইসলামের ইতিহাসে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে দেখা যায়, মক্কা বিজয়ের দিন আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ স. বিজয়ীবেশে মক্কায় প্রবেশ করলে কুরাইশদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু রাসুলে কারীম স. বিজিত শত্রুদের প্রতি কোন ধরনের দুর্ব্যবহার করেননি এবং কিঞ্চিৎ পরিমাণ প্রতিশোধস্পৃহাও প্রকাশ করেননি, বরং দুশমনদের প্রতি ক্ষমা ঘোষণা করেছেন। তিনি কুরাইশদের বলেছেন, ‘হে কুরাইশগণ ! আমি তোমাদের সাথে কেমন ব্যবহার করবো বলে তোমরা মনে করো? তারা বললো, ‘আপনি আমাদের প্রতি ভালো ব্যবহার করবেন বলে আমাদের ধারণা। আপনি দয়ালু ভাই। দয়ালু ভাইয়ের পুত্র। অতঃপর রাসূল স. সূরা ইউসুফের ৯২ নং আয়াত তিলাওয়াত করে বললেন, আমি তোমাদের সাথে সেই কথাই বলছি, যে কথা হযরত ইউসুফ আ. তাঁর ভাইদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘আজ তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই। যাও তোমরা সকলেই মুক্ত।’ -(আর-রাহীকুল মাখতুম (উর্দু) পৃষ্ঠা-৬৩৩)।
প্রতিশোধের পরিবর্তে শত্রুদের প্রতি রাসুলে কারীম স. এর ক্ষমা ও মহানুভবতার এমন অসংখ্য দৃষ্টান্ত শান্তি- সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় ইসলামের চিরন্তন আদর্শের জানান দেয়। পারস্পরিক সাক্ষাতে সালাম বিনিময়ের যে বিধান ইসলামে রয়েছে তাও সম্প্রীতির বন্ধন সুসংহতকরণের উজ্জ্বল প্রয়াস। ‘সালাম’ অর্থ শান্তি। সালাম বিনিময়ের মাধ্যমে মূলত একে অপরের শান্তিই কামনা করেন। এতে ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতির সেতুবন্ধন রচিত হয়।
উপরোক্ত আলোচনায় সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়, বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি, শান্তি, সৌহার্দ্যপূর্ণ সহাবস্থান ও সদ্ব্যবহার ইসলামের অনুপম শিক্ষা। শান্তি ও মানবতার পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান ইসলাম সংঘাত, সহিংসতা, বিশৃঙ্খলা ও সাম্প্রদায়িকতাকে চরমভাবে ঘৃণা করে।
আসুন! রাসুলে কারীম স. এর শাশ্বত আদর্শের আলোয় নিজেদের আত্মাকে আলোকিত করি। আত্মনিবেদন করি শান্তিপূর্ণ, আলোকিত রাষ্ট্র বিনির্মাণে।
লেখক :
হাফেজ মুহাম্মদ আবুল মঞ্জুর- যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, কক্সবাজার ইসলামী সাহিত্য ও গবেষণা পরিষদ। সভাপতি, রামু লেখক ফোরাম।