জাতীয়

সহনশীল থেকে শান্তি প্রতিষ্ঠা চায় সরকার

কোটাবিরোধী আন্দোলনের শুরুতে সরকারের একাধিক কৌশলগত ভুল হয়ে গেছে। এ কারণে তারা দেশে-বিদেশে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়েছে। এমন অবস্থায় এখন তাড়াহুড়া করে কোনো সিদ্ধান্ত না দিয়ে ভেবেচিন্তে পা ফেলতে চাইছে সরকার ও আওয়ামী লীগ। তারা কোনো উসকানিতে পা না দিয়ে সর্বোচ্চ সহনশীলতা দেখিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে চায়।

ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা কালের কণ্ঠকে এমনটা জানিয়েছেন।আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ বলেন, ‘আমরা চাচ্ছি দেশে একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ আসুক। দেশের অনেক ক্ষতি হচ্ছে। আমদানি-রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও চাচ্ছেন যা-ই হয়েছে—এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হোক। কিছু উসকানিদাতার জন্য অনেকে বিভ্রান্ত হচ্ছে।’দলীয় একাধিক সূত্র মতে, একসঙ্গে দ্বিমুখী বড় চাপ সামাল দিতে হচ্ছে সরকারকে। একদিকে দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনা, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের ইউরোপীয় মিত্রদের বড় চাপে রয়েছে সরকার।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা জানান, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি কিভাবে সামাল দেওয়া যায়, তা নিয়ে দল ও সরকারের অভ্যন্তরে প্রতিনিয়ত আলোচনা চলছে। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত কোনো বিষয়ে তারা জনগণের মুখোমুখি হয়নি। বরং আওয়ামী লীগের সঙ্গে জনগণ একাত্ম হয়ে নানা ঐতিহাসিক ঘটনার জন্ম দিয়েছে। এবারই প্রথম দেশের নানা দল-মতের মানুষ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নেমেছে। কেন এমনটা ঘটছে, তা নিয়ে দলের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে নানা বিশ্লেষণ চলছে।

কিভাবে বিক্ষুব্ধদের শান্ত করা যায়, সে বিষয়ে কার্যকর পথ খোঁজা হচ্ছে।

ঢাকা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের নেতাকর্মীদের সহনশীল থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে কেউ যেন সহিংসতা সৃষ্টি করতে না পারে, সেদিকেও সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া বর্তমান পরিস্থিতিতে সংগঠনের ঘর গোছানোকেও বড় কাজ মনে করছি। সে কাজগুলোও আমরা করছি।’

দলীয় একাধিক সূত্র মতে, আন্দোলনকারীদের সঙ্গে মুখোমুখি কোনো সংঘর্ষে যেতে চায় না আওয়ামী লীগ। তবে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার ফলে তারা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে মিশে গিয়ে সহিংসতার চেষ্টা করতে পারে। এ কারণে রাজপথে বড় জমায়েতের কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে নিজেদের সাংগঠনিক শক্তির প্রমাণ দেখাতে চায়। আজ শনিবার রাজধানীতে বড় শোকযাত্রা করবে আওয়ামী লীগ। বিকেল ৩টায় রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন থেকে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবন পর্যন্ত এই শোকযাত্রা হবে। এই কর্মসূচিতে বড় জমায়েত নিশ্চিত করতে দলের নেতাকর্মীদের কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা ব্যাপক জমায়েতের প্রস্তুতি নিয়েছি। প্রতিটি থানা ও ওয়ার্ডের নেতাকর্মীরা যেন বড় জমায়েত নিয়ে শোকযাত্রায় আসেন, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।’

একাধিক সূত্র মতে, আন্দোলন নিরসনে শিক্ষার্থীদের নেতাদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা চলছে যে এই আন্দোলনের ওপর ভর করে একটি মহল দেশে অরাজকতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। যেহেতু কোটা সংস্কারের মূল দাবি পূরণ হয়েছে, সে কারণে এ আন্দোলন যেন প্রত্যাহার করা হয়, সে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

দলীয় একাধিক নেতার মতে, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টার অংশ হিসেবে আন্দোলনকালে সহিংসতা, নাশকতার ঘটনার মামলায় যারা জড়িত নয়, তাদের বিরুদ্ধে কোনো হয়রানিমূলক ব্যবস্থা না নিতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এইচএসসি পরীক্ষার্থী যেসব শিক্ষার্থী গ্রেপ্তার হয়েছিল, তাদের জামিন ও পরীক্ষায় অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করছে সরকার।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা জানান, সে রকম পরিস্থিতি তৈরি হলে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিংবা অন্য গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের শিক্ষার্থীদের নেতাদের সঙ্গে বসে আলাপ করার সম্ভাবনা রয়েছে।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তিন মন্ত্রীর আলোচনা হয়েছে। আলোচনা চালু রাখার জায়গাটা এখনো আছে, সেটা কিন্তু নষ্ট হয়নি। প্রধানমন্ত্রীও তাদের সঙ্গে বসে কথা বলতে পারেন। আমরা চাই দেশে শান্তি ও সম্প্রীতির পরিবেশ বজায় থাকুক। শান্তি ফিরিয়ে আনাটাই এখন আমাদের বড় কাজ।’

আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এই ঘটনা কাঙ্ক্ষিত ছিল না। যা ঘটেছে সেটা সবার জন্যই দুঃখজনক, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এ পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার জন্য আমরা দেশের তরুণসমাজকে নিয়ে কাজ করব। তারাই দেশের ভবিষ্যৎ। আমরা পুনরায় তাদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে চাই।’

দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও পক্ষে আনার চেষ্টা করছে সরকার। আন্দোলনকালে হতাহতের বিষয়ে নানা অতিরঞ্জিত প্রচারণার বিষয়টি বিদেশিদের কাছে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। সরকারের দিক থেকে নানা তথ্য তুলে ধরা হচ্ছে। এমনকি আন্দোলন চলাকালে নিহতদের বিষয়টির সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্তে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্তে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের আওতা বাড়ানো হয়েছে। তিনজন বিচারপতিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তদন্তে জাতিসংঘসহ যেকোনো দেশ কিংবা সংস্থা চাইলে যোগ দিতে পারে। সরকার তাকে স্বাগত জানাবে।’

ওবায়দুল কাদের শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন।

গণভবনে জরুরি বৈঠক

আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল রাতে গণভবনে দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করেছেন।

বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী বলেন, ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলনে যে দাবি ছিল, তা সরকার মেনে নিয়েছে। এর পরও তারা যে আন্দোলন করছে, তা ধৈর্য ধরে মোকাবেলা করার নির্দেশনা দেন শেখ হাসিনা। এমনকি উদ্ভূত পরিস্থিতে শিক্ষার্থীরা যাতে কোনো হয়রানির শিকার না হয়, সেদিকেও নজর রাখতে নির্দেশ দেন তিনি।

এদিকে সংগঠনকে আরো শক্তিশালী করতে করণীয় ঠিক করতেও দলের সিনিয়র নেতাদের নির্দেশ দেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘দলের মধ্যে যে সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা রয়েছে, তা দ্রুত মিটিয়ে সংগঠনকে শক্তিশালী করতে হবে। ভবিষ্যতে এমন আরো খারাপ পরিস্থিতি আসতে পারে। সে ক্ষেত্রে যেন আমরা সাংগঠনিকভাবে মোকাবেলা করতে পারি, সেদিকটিও নজর দিতে হবে।’

বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাক, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ও সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *